Header Ads Widget

গল্প টা পড়ে চোখে জল এসে গেল। এভাবেই বেঁচে থাকুক সকল ভালো বাসা

 #প্রাক্তন_যখন_বর্তমান

©শ্রাবন্তী_মিস্ত্রী


আমি করবী সেন, আমার মা অদিতি সেনের একমাত্র মেয়ে। বর্তমানে লন্ডনের একটা খ্যাতনামা হাসপাতালে চিকিৎসাবিদ্যা নিয়ে লেখাপড়া করছি। মা থেকে গেছে আমার জন্মস্থান ভারতবর্ষে। মাকে কথা দিয়েছি পড়া শেষে ফিরবো তার কাছেই। আমি জানি আমাকে ছাড়া আমার মা ভীষণ একলা। বছরে বেশ কয়েকবার মায়ের কাছে যাই। মাকে অনেকবার বলেছি আমার কাছে চলে আসতে,মা বলেছে অপেক্ষা করবে আমার জন্য তাও দেশের মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকবে। মাঝ রাতে বইয়ে মুখ গুঁজে পড়তে পড়তে মনে হয় এইসময় যদি মা পাশে থাকতো বেশ হতো। মা কখনো কষ্টের আঁচ লাগতে দেয়নি আমার উপর। সব আঘাত নিজে সহ্য করে গেছে সারাজীবন ধরে। সেদিন যদি মায়ের বাক্স খুলে পুরনো চিঠি গুলো না পড়তাম তাহলে জানতেই পারতাম না নিজের সন্তানের জন্য একটা মা ঠিক কতোটা আত্মত্যাগ করতে পারে। আমি ভগবান দেখিনি কিন্তু আমার মাকে দেখেছি। আমি যে মায়ের সব গল্প জেনে ফেলেছি তা মা জানে না। মা তো চিরকাল তার কষ্টের আড়ালে হাসিমুখটা দেখিয়েছে আমাকে। মায়ের চিঠি পড়েছি তিন বছর হয়ে গেছে তারপর থেকে ভেবে এসেছি কিভাবে মাকে একটু সুখী দেখতে পারি, কিন্তু পারিনি। তবে আমার মাকে ভালো রাখার এমন একটা সুযোগ আমি পেয়ে যাবো আমি কখনো কল্পনাও করিনি।
সেদিন আমাদের ইউনিটের পেশেন্টের ফাইলগুলো দেখতে দেখতে একটা নাম দেখে থমকে গেলাম হঠাৎ করে। ফাইল হাতে সোজা হন্তদন্ত খেয়ে পৌছালাম পেশেন্টের কেবিনে। দেখলাম সেই সৌম্য চেহারার ভদ্রলোক চিত হয়ে চোখ বুজে শুয়ে। আমি ওনাকে না ডেকেই ওনার মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে রইলাম। এইতো সেই মুখ,মায়ের কাঠের বাক্সে সযত্নে রাখা সাদা কালো ফটোতে এই মুখটাই তো দেখেছিলাম আমি। একটার পর একটা চিঠির লেখাগুলো ভেসে উঠলো আমার কাছে।
প্রিয় দিতি,
আমি জানি তুমি ভালো নেই। তোমার উপর আমার অনেক অভিমান জানো,কিন্তু রাগ নেই এতোটুকু। কাউকে নিজের সবটুকু উজাড় করে ভালোবাসলে হয়তো তার উপর রাগ করা যায় না। সেদিন সন্ধ্যায় রক্তকরবী ফুলগুলো যেনো আরো রক্তাক্ত দেখাচ্ছিল,মনে হচ্ছিল ওরা বুঝি আমার হৃৎপিন্ডের সব রক্ত শুষে নিজেদের সাজিয়েছে। সারারাত অপেক্ষা করেছিলাম ওই গাছের নীচে বসে,তবুও তুমি এলে না। ভোর হতেই তোমাদের বাড়ি থেকে ভেসে এলো সানাইয়ের সুর, গাঁয়ের পুকুর ধারে দেখলাম মেয়েদের হাঁকডাক তাদের আদরের দিতির গায়ে হলুদ বলে কথা। যখন মনে হচ্ছিল আর কিছু সময় পর তুমি অন্যকারো হয়ে যাবে,মনে হচ্ছিল ছুটে গিয়ে সব শেষ করে এই বুকে তোমাকে জড়িয়ে ধরে বলি তুমি শুধু আমার আর কারো নয় কিন্তু পারিনি আমি। দুচোখ ভরা জল নিয়ে গ্ৰাম ছেড়ে চলে এসেছিলাম দূরের শহরে।
দু বছর পর গ্ৰামে ফিরে তোমার বান্ধবী হীরার মুখে সব শুনলাম তোমার উপর তোমার স্বামীর অত্যাচার আর কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার কারণে তোমাকে পরিত্যাগ করার ঘটনাও। তোমার ছোট্ট সোনার নাম রেখেছো করবী শুনে চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়েছে জানো? আচ্ছা দিতি আর কতোদিন বলোতো? আর কতোদিন? আমি এটাও জেনেছি কাকা আর তার ছেলেরা তোমার মৃত বাবা মায়ের সব সম্পত্তি নিজেদের নামে করে তোমাকে প্রতিনিয়ত অপমান অবহেলা করে চলেছে। দিতি এই চিঠির নীচে শহরের একটা বাড়ির ঠিকানা দিয়ে দিলাম তিনমাসের ভাড়া দেওয়াই আছে আর নীচে বেশ কিছু চাকরির খোঁজ। তুমি তো একসময় আমাদের স্কুলের মেধাবী ছাত্রীদের একজন ছিলে। আমি জানি তুমি ঠিক পারবে নিজের সন্তানকে নিয়ে সাবলম্বী হয়ে বাঁচতে। আমি এই সাহায্যটুকু করেই চলে যাবো এ দেশ ছেড়ে। তোমার ছোট্ট মেয়ের জন্য রইলো অনেক আদর।
ইতি
হতভাগ্য নিখিলেশ
প্রিয় নিখিল,
তোমার শেষ চিঠির জবাব লিখতে লিখতে আমার সারাজীবন কেটে যাবে কিন্তু জানি কখনো চিঠিগুলো তোমার কাছে পৌঁছবে না। নিখিল শুধু অভিমানই করে গেলে একটুও বুঝলে না আমাকে। তুমি তো জানতে বলো আমি ভীতু চিরকাল। সেদিন রাতে ভেবেছিলাম সব ছেড়ে তোমার হাত ধরে ঘর ছাড়বো,নতুন সংসার গড়বো তোমার সাথে। বিশ্বাস করে বলেছিলাম কথাটা কাকার মেয়ে পিউকে কিন্তু সে কথা পৌঁছলো কাকা কাকির কানে,আর ঘর ছাড়া হল না। মরা বাপ মায়ের দোহাই দিয়ে জোর করে বিয়ে দেওয়া হল বিপত্নীক সমরেশ সরকারের সাথে। তারপর জানো ভেবেছিলাম আস্তে আস্তে তোমাকে ভুলে যাবো, কিন্তু পারিনি জানো প্রতিটা মূহুর্তে তোমার স্মৃতিগুলো আমাকে অস্থির করে তুলেছে। তারপর মা হলাম। কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার অপরাধে শ্বশুরবাড়ি ছাড়া হলাম। বাড়ি ফিরতেই কাকা বললো আমি নাকি বোঝা,আমার বাবার সম্পত্তিতে আমার মালিকানা আর নেই। নিজের বাড়িতে কাজের লোকের মতো পড়েছিলাম আমি তারপর হীরার হাতে তোমার চিঠি পেলাম। আমি পেরেছি নিখিল। সব ছেড়ে আমি আমার মেয়েকে নিয়ে চলে এসেছি তোমার দেওয়া নতুন ঠিকানায়। এখন আমি সাবলম্বী। বাচ্ছাদের স্কুলে পড়ানোর চাকরীটা জুটে গেছে। তুমি না থাকলে হয়তো আমি কখনোই পারতাম না এতোকিছু। আমার এখন একটাই লক্ষ্য তোমার আদর্শ দিয়ে আমার সন্তানকে বড় করার।
ইতি
দিতি
প্রিয় নিখিল,
জানো নিখিল আমার মেয়েকে আমি মনের মতো করে বড় করেছি। ও এখন ডাক্তারির ছাত্রী। আমি বুড়ি হয়েছি বুঝলে, মাথার চুলে পাক ধরেছে। তবে আমার খুব গর্ব আমার মেয়েকে নিয়ে। নিখিল একটাবার যদি আমার করবীকে দেখতে বুঝতে দিতি কতোটা সুখী। আমার মেয়ে আমার জগত। ওকে ছাড়া একটা দিন চলে না আমার। জানো আমার মেয়ের ভালোবাসাটাকে আমি উপযুক্ত মর্যাদা দিয়ে খুব খুশি। আমি খুব সহজেই মেনে নিয়েছি অনুজ আর ওর সম্পর্কটা। ওদের বিয়ে দেবো ঠিক করেছি দুজনের পড়া শেষ হলে। অনুজের বাবা নেই ওর মায়ের মত নিয়ে তবেই স্বস্তি পেয়েছি। আমি চাই না আমার মতো কেউ চিরকাল হাহাকার করুক একটু ভালোবাসার জন্য। আচ্ছা নিখিল তুমি বিয়ে করেছ নিশ্চয়ই। তোমার স্ত্রী সত্যিই খুব ভাগ্যবতী। কথা মতো রোজ রাতে গোলাপ নিয়ে বাড়ি ফেরো নিখিল? আচ্ছা সিগারেট টাকি আজও তোমার নরম ঠোঁট পোড়ায় নাকি স্ত্রী'র আব্দারে সে অভ্যাস ছেড়েছ? খুব হিংসুটে শোনাচ্ছে নাগো নিখিল? সত্যিই হিংসুটে হয়ে গেছি আমি। কিন্তু যতো দূরেই থাকি এটাই চাই তুমি ভালো থাকো সবসময়।
ইতি,
দিতি
চিঠির কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে গেছিলাম আমি। হঠাৎ ভদ্রলোক বলে উঠলেন-"হ্যালো ডক্টর গুড ইভিনিং।"
মৃদু কাঁপা গলায় বলে উঠলাম-"আপনি নিখিলেশ বোস তো?"
ভদ্রলোক এবার উৎসাহিত হয়ে বললেন-" আরে বাঙালী দেখছি, ভারতের রত্ন বিদেশের মাটিতে কেনো?"
কি জানি কি হল আমার হাসপাতালের বেডে বসা লোকটার সামনে পা মুড়ে বসে প্রণাম করলাম আমি। উনি অনেক আশির্বাদ আর আদর করলেন আমায়। আমি ওনার হাতটা শক্ত করে ধরে বললাম-" আপনাকে আমি আর ছাড়ছি না পেয়েছি যখন একবার।"
উনি হাসি মুখে তাকালেন আমার দিকে। আর তারপর ওনার ডিসচার্জ হবার পর সোজা পৌঁছে গেলাম ওনার বাড়ির ঠিকানায়। ওই ঠিকানায় পেলাম বিশ্বাস আর ভরসার সেই বুকটা যেটার অভাব ছিল ছোটবেলা থেকে। আমার মায়ের নাম শুনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিখিলেশ বোসের চোখে জল দেখলাম। তারপর স্পষ্ট জানিয়ে দিলাম আপনাকে আঙ্কেল বলে ডাকার ইচ্ছে কিন্তু আমার নেই। ভদ্রলোককে বললাম ছয় মাস অপেক্ষা করতে আমার এখানকার কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত, একজন যে ওনার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছেন সেটাও জানালাম।
আজ ২২ শে মার্চ আমার আর অনুজের বিয়ে। কনে সাজে আমি তৈরি। সবাই বলছে খুব সুন্দর লাগছে আমাকে,আর একজনকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর লাগছে সেটা হল আমার মা। আমি মাকে নিজের হাতে সাজিয়েছি আজ। মা আপত্তি করেছিল বটে,কিন্তু সেসব শোনার পাত্রী আমি নই। আজ দুটো মন বাঁধা পড়বে একসাথে, আজ থেকে চারজন ভালোবাসার মানুষ একসাথে থাকবে। আজ শুধু আমার নয় আমার মায়ের ভালোবাসাও পূর্ণতা পাবে। মা এখনো জানে না মায়ের জন্য বরবেশে অপেক্ষা করছে তার সখা তার প্রাণের নিখিল।
ছবি : সংগৃহীত
সমাপ্ত
** নিয়মিত লেখা পেতে পেজটি লাইক এবং ফলো করুন।

গল্প টা পড়ে চোখে জল এসে গেল। এভাবেই বেঁচে থাকুক সকল ভালো বাসা


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ