বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করে। দেশে তামাকজনিত রোগে বছরে এক লাখ ৬১ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়।
গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজ স্টাডি, ২০১৯ এর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে মৃত্যু ও পঙ্গুত্ববরণের প্রধান চারটি কারণের একটি তামাক ব্যবহার। তামাক ব্যবহারে বার্ষিক অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা।
সোমবার (৩০ মে) বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস ২০২২ উপলক্ষে গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) এসব তথ্য তুলে ধরে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তামাক কোম্পানিগুলো বছরে ৮৪ মিলিয়ন টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমণ এবং ৬ ট্রিলিয়ন সংখ্যক সিগারেট শলাকা উৎপাদনের জন্য ২২ বিলিয়ন টন পরিমাণ পানি অপচয় করে। এছাড়াও ৬০ কোটি বৃক্ষনিধনের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক সম্পদ বিনষ্ট এবং ইকোসিস্টেমে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করছে।
প্রতি বছর ৪ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন সিগারেট ফিল্টার আবর্জনা হিসেবে প্রকৃতিতে জমা হয়, যার ওজন প্রায় ৭ লাখ ৬৬ হাজার ৫৭১ মেট্রিক টন। ফেলে দেওয়া বর্জ্য হিসেবে এটির অবস্থান শীর্ষে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিশ্বের ৯০ ভাগ তামাক উৎপাদন হয়, যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
বাংলাদেশের পরিবেশ, অর্থনীতি এবং সমাজের ওপর তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব তুলে ধরে বিবৃতিতে বলা হয়, বিশ্বের মোট তামাকের ১ দশমিক ৩ শতাংশ উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। আবাদযোগ্য জমিতে তামাক চাষের কারণে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে রয়েছে।
টোব্যাকো অ্যাটলাসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় ৩১ শতাংশ বননিধনের জন্য তামাক দায়ী। এছাড়া তামাক চাষে ব্যবহৃত অতিরিক্ত কীটনাশক ও সার বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে জলাশয়ে মিশে ক্ষতিগ্রস্ত করছে দেশের মৎস্য উৎপাদন। দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননকেন্দ্র হালদা নদী এরইমধ্যে হুমকির মুখে পড়েছে।
তামাকের পরিবেশগত ক্ষতির অন্য একটি বড় কারণ পরোক্ষ ধূমপান। বাংলাদেশের ৪ কোটিরও বেশি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ বাড়িতে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়, যার সিংহভাগই নারী। কর্মস্থলে ও গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়, এমন ব্যক্তির সংখ্যা যথাক্রমে ৮১ লাখ এবং ২ দশমিক ৫ কোটি। ঢাকা শহরের প্রাথমিক বিদ্যালয়গামী শিশুদের ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় শতকরা ৯৫ ভাগের মুখের লালাতে উচ্চমাত্রায় নিকোটিন পাওয়া গেছে, যা মূলত পরোক্ষ ধূমপানের ফল। পরোক্ষ ধূমপান মৃত্যু ঘটায় এবং হৃদরোগ, ফুসফুসের ক্যানসারের মতো মারাত্মক রোগের অন্যতম কারণ।
এছাড়া বাংলাদেশেও সিগারেটের ফেলে দেওয়া ফিল্টার পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে মোট ৭১ বিলিয়ন সিগারেট শলাকা উৎপাদিত হয়েছে। সিগারেটের ফেলে দেওয়া ফিল্টার প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যেতে প্রায় এক দশক সময় নেয়, আর মিশে যাওয়ার সময় এ থেকে সাত হাজারেরও বেশি রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হয়। কেবল সিগারেটই নয়- জর্দা ও গুলের মতো ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যগুলোও প্লাস্টিকের কৌটা ও পলিথিন প্যাকেটে ভরে বিক্রি করা হয়, যা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
বিবৃতিতে তামাক কোম্পানিগুলোর সমালোচনা করে বলা হয়, পরিবেশের ক্ষতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকার পরও তামাক কোম্পানিগুলো নিজেদের পরিবেশবান্ধব হিসেবে উপস্থাপন করে তথাকথিত সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক কর্মসূচির (সিএসআর) মাধ্যমে। তাদের এ কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে তামাক চাষের কারণে বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাকৃতিক সম্পদ ও ইকোসিস্টেমের ওপর যে বিরূপ প্রভাব পড়ছে, তা আড়াল করে রাখা। এর পাশাপাশি প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে ব্যবসায়িক স্বার্থ হাসিল করা।
বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস উপলক্ষে এক প্রতিক্রিয়ায় তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞা’র নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বলেন, তামাক উৎপাদন ও ব্যবহারের কারণে আমাদের আবাদযোগ্য জমি, বনভূমি, মৎস্যক্ষেত্র প্রভৃতি সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর ব্যাপক চাপ পড়ছে। পরিবেশ, প্রতিবেশ, জলবায়ু এবং খাদ্য নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে তামাক। সরকারের উচিৎ শক্তিশালী আইন ও কর আরোপ সংক্রান্ত কঠোর পদক্ষেপের মাধ্যমে তামাকের আগ্রাসন বন্ধ করা।
0 মন্তব্যসমূহ