গরিব বাবার দেনা যেভাবে শোধ করলেন তিন মেয়ে
লিপি বেগমের ভাড়া বাড়ির স্যাঁতসেঁতে দেয়ালে একটা চকচকে ছবি আছে। ঢাকার পূর্বাচলের কাঞ্চনপুরের এক ফেরিওয়ালার কাছ থেকে ৫০ টাকা দিয়ে ছবিটি কিনেছেন তিনি। ওভারটাইমের টাকা দিয়ে ছবিটি কেনা। লিপি ওভারটাইমে প্রতি ঘণ্টায় ৫২ টাকা করে পান।তবে ওভারটাইম আপাতত বন্ধ। আসলটুকু করতেই প্রাণান্ত। চলাফেরায় জড়তা আসছে। তিন মাসের সন্তানসম্ভবা লিপির এই মাথা ঘোরে, তো সেই গা গুলিয়ে আসে। প্রথমবার মা হতে যাচ্ছেন তিনি।শীতের সকালে রোজ সাতটার আগেই উপস্থিত হতে হয় বাসস্ট্যান্ডে। ফিরতে ফিরতে কোনো দিন রাত নয়টা। অর্ডারের চাপ থাকলে ২৪ ঘণ্টা কাজ করে পরদিন ফিরে আসে বিধ্বস্ত শরীরে। পূর্বাচলের কাঞ্চনপুরের এক পোশাক কারখানার শ্রমিক লিপির সঙ্গে অন্য পোশাকশ্রমিকদের বিশেষ ব্যবধান নেই।তবে চার বছর আগে এ কাজ শুরুর সময় লিপি ছিলেন জামালপুরের সরিষাবাড়ীর টঙ্গী
হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী। মানবিক শাখায় নবম শ্রেণিতে জিপিএ ৪.৮৫ পেয়েছেন তিনি। আত্মবিশ্বাস বাড়ছিল প্রতি ক্লাসের ফলাফলে।ছোট বোন মিনা আক্তার তখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। বড় বোন মনিকা আক্তারের বিয়ে হয়েছে। সরিষাবাড়ীর নজরুল মোল্লা অভাবী মানুষ হলেও তাঁর নিজের বসত ছিল। ছোট্ট দুটো ঘর, তবে নিজের। ছেলেমেয়ে বড় হতে হতে খরচ বাড়ছিল। দিনমজুরের আয় দিয়ে আর মেয়েদের স্কুলের খরচা কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না।বোনের স্বামীর কাছ থেকে ট্রাক্টর ধার নিয়েছিলেন। ট্রাক্টর দিয়ে অন্যের জমিতে চাষ করতেন। দুর্ভাগ্য হলে যা হয়। একদিন ট্রাক্টর চালিয়ে এসে বাড়ির বাইরের উঠানে রেখে স্ত্রীকে ভাত দিতে বললেন। ভাত খেয়ে বাইরে এসেই আবার কাজে যাবেন। এইটুকু সময়ের মধ্যেই তাঁর ভাগ্যের চাকা সাঁই করে ঘুরে গেল তলার দিকে। এসে দেখেন উঠান ফাঁকা। চোর আর ধরা পড়ল না কোনো দিন।এদিকে
বোনের সংসারে অশান্তি শুরু হয়েছে। অগত্যা স্থানীয় সমিতি থেকে, আশপাশের মানুষের কাছ থেকে ধার নিলেন ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। আগের ধার মিলে দেনা প্রায় দুই লাখে পৌঁছাল। একার মজুরিতে তখন চাল কেনার টাকাও হয় না।দুদিন আগেও নজরুল তাঁর মেধাবী দুই মেয়েকে নিয়ে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতেন। দেনার দায়ে, সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে না পারার কষ্টে, লিপি আর মিনার স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার আঘাতে স্ট্রোক করলেন তিনি। বাঁ পাশ হয়ে গেল স্থবির। হাতটাও তুলতে পারেন না এখন।উপোসের দিন শুরু হলো পুরো পরিবারের। অভাবের সংসারের মেধাবী দুই ছাত্রী এবার পরিবারের হাল ধরল। বড় বোন বিয়ের পর থেকে স্বামীর সংসার সূত্রে আগেই চলে এসেছেন ঢাকায়। এবার ছোট দুই বোনও রাজধানীতে এল, তবে কাজের খোঁজে।কাঞ্চনপুরের একটি পোশাক কারখানায় কাজ নিল লিপি আর মিনা। এদিকে শুরু হলো ধারের
টাকার চাপ। এক মাসের সুদ দেওয়াই কষ্টের, আর তো আসল! একদিকে বাবার চিকিৎসা, অন্যদিকে ধারের টাকার তাগাদা। ছোট দুই বোনের সঙ্গে যোগ দিলেন বড় বোন মণি। তিন বোনের উপার্জন মিলিয়ে প্রায় চার বছর সময় লেগেছে বাবার ধারদেনা শোধ করতে।বাবা আর মাকে নিয়ে এসে খিলক্ষেতের নয়াপাড়ায় দুই রুমের একটি ঘর ভাড়া নেয় দুই বোন। সেখানে এক রুমে থাকেন লিপিদের বেকার বড় ভাই ও তাঁর স্ত্রী। আরেক রুমের খাটে থাকেন লিপির বাবা-মা। একপাশের মেঝেতে ঘুমায় ছোট ভাই। বাথরুমে যাওয়ার পথটুকুতে প্রতি রাতে কাঁথা পেতে শুয়ে থাকে ছোট বোন মিনা। ছোট্ট ঘরে চারজনের বসবাস। প্যারালাইজ বাবাকে রাতে উঠিয়ে ধরে নিতে হয় বাথরুমে। তখন ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে একপাশে উঠে বসে থাকে মিনা।খুব সকালে তাকে ছুটতে হয় কারখানায়। তিন দিন দেরি হলে এক দিনের বেতন কাটা যায়। সারা দিনের খাটুনির পর রাতের ঘুমটুকু ওর খুব প্রয়োজন। মাঝেমধ্যে আর ঘুম আসে না। সারা রাতই জেগে থাকে। নয়াপাড়ার সে ঘরের জায়গাটুকুতে একজন মানুষের হাত-পা মেলে বসার জায়গাও হয় না।মিনার মা বলছিলেন, ‘অভাব ছিল, কিন্তু আমার মেয়েরা বাবার খুব আদরেরও ছিল। মাস্টার, কোচিং ছাড়াই ভালো ফলাফল করত বলে আশা করেছিলাম,
ওরা অনেক বড় হবে। ভাগ্যে ছিল আরেক রকম। নিজের ভিটামাটি পর্যন্ত ছাড়তে হলো দেনার দায়ে। উদ্বাস্তু হয়ে ঢাকা শহরে আসলাম। আট হাজার টাকার এই ঘর ভাড়া দুই মাস বাকি পড়লেই পথে গিয়ে দাঁড়াতে হবে এক কাপড়ে।’দুই বছর আগে লিপির বিয়ে হয়েছে অন্য এক পোশাক কারখানার কর্মচারীর সঙ্গে। তিনি তাঁর স্বামীর বাড়িতে থাকেন বনরূপার ঘিঞ্জি ঘরে। সেখানে অপরিকল্পিত ছোট ছোট টিনশেড বাড়ি করে ভাড়া দেওয়া হয়েছে অল্প আয়ের মানুষদের। যাদের অধিকাংশ প্রহরী বা পোশাক কারখানার শ্রমিক।বাড়ির সঙ্গে খোলা ড্রেনে মাছি ভন ভন করছে। কারও বাড়ির ময়লার ব্যাগ নিয়ে পথেই খুলে ছড়াচ্ছে বেওয়ারিশ কুকুরের দল। সে আবর্জনাময় উন্মুক্ত ড্রেনের ওপর ঝুলছে কারও রোদে শুকাতে দেওয়া ওড়না।কাঞ্চনপুর থেকে লিপির খবর পেয়ে বনরূপার বাড়িতে ঢুকে দেখা গেল, সেদিন বিকেলে তিনি বসে তরকারি কাটছেন রাতের রান্নার জন্য। অসুস্থ বলে এক দিন ডে অফ পেয়েছেন। পোশাক কারখানাগুলোতে এক দিনের ছুটি থাকলেও সাধারণত মেয়েরা ওভারটাইমের জন্য সে দিনটাও কাজ করতে চায় বলে জানালেন তিনি।পড়াটা কোনোভাবে চালিয়ে যাওয়া যেত কি না জানতে চাইলে লিপি বললেন, ‘তাহলে বাবার ধারের টাকা শোধ হতো না। চিকিৎসা হতো না তাঁর। স্কুল, ক্লাসরুম, সেই পাঠ্যপুস্তকের কথা আর আমার মনে করতে ইচ্ছা হয় না।’সম্প্রতি শেষ হয়েছে নজরুলের ধারের টাকা শোধ। তিন মেয়ে উপার্জন করে বাবার দেনা শোধ করেছেন চার বছরে। মাত্র দুই লাখ টাকা। কিন্তু স্কুল ছাড়তে হয়েছে দুজন মেধাবী ছাত্রীর। পুরো পরিবারটির ঠাঁই হয়েছে রাজধানীর ঘিঞ্জি গলিতে।শরীর খারাপ লাগলে সেদিন কাজে যেতে খুব কষ্ট হয় ছোট্ট মিনার। মেঝের ওই হিমশীতল বিছানাটাই তাকে টেনে ধরে রাখতে চায় অদৃশ্য হাত-পা দিয়ে। নয়াপাড়ার বাড়িতে মেয়ের টুকটাক সাজগোজের জিনিস দেখিয়ে ওদের মা বলছিলেন, ‘ভোরবেলা আমার মেয়েটার মুখ যদি দেখতেন! অথচ স্কুলে যাওয়ার জন্য কোনো দিন জাগায় দিতে হতো না। খুব পড়তে চাইত মেয়েরা।’মিনার মা বলেন, ‘এখন মাঝেমধ্যে ঘুমের ভেতর স্বপ্ন দ্যাখে। হঠাৎ জেগে বসে বলে, মা আমি তাইলে এতক্ষণ স্কুলের মাঠে ছিলাম না? এইটা স্বপ্ন ছিল? তখন আমার বুকের ভেতর মনে হয় ঢেঁকির পাড় পড়তেছে। মেয়েদের পড়ালেখা করানোর স্বপ্ন দেখে ওদের বাবা উপার্জনটা বাড়াইতে চাইল। ফল হইলো, ওরা আর স্কুলেই যাইতে পারল না। হয়ে গেল পোশাকশ্রমিক। পঙ্গু হয়ে যাওয়ার পর থেকে ওদের বাবা তো আর কথা বলতে পারে না। মেয়েদের দেখলে ওনার শুধু চোখ দিয়ে গড়ায় পানি পড়ে।’বনরূপার অন্ধকার ঘরে বসে লিপি বললেন, ‘কয়েক বছর ধরে বাবার দায়টা তিন বোন মিলে শোধ করছি কেমন করে জানেন? প্রতি মাসে হাতের সব টাকা একসঙ্গে রাখতাম আমরা। সেখান থেকে যেটুকু না হলেই না, ওটুকু রেখে দিতাম নিজেদের জন্য। সব টাকা চলে যেত ধার দেওয়া মানুষের পকেটে। ওই টাকায় আমাদের তিন বোনের সারা মাসের কষ্ট জমা আছে। পড়তে না পারার, স্কুলে যেতে না পারার কষ্ট। এই সবেমাত্র ধারটা শোধ হইলো। তবে কয়েকটা বছর চলে গেল। এই শহরে এসে আয় করে ধার শোধ করলাম ঠিকই। কিন্তু জীবনটাই বদলায় গেল আমাদের।
0 মন্তব্যসমূহ